অলিউল্লাহ নোমান
ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসির রায় প্রদানকারী বিচারকদের উচ্চ পদে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। পুরস্কৃত করতে সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে তাদের নেয়া হচ্ছে আপিল বিভাগে। গত বুধবার ২১ জনকে ডিঙ্গিয়ে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয় ওবায়দুল হাসান শাহিনকে। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান ছিলেন। ট্রাইব্যুনালে রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসির পুরস্কার হিসাবেই তাঁকে এ পদে নেয়া হয়। অনুরূপভাবে পুরস্কৃত করতে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী এম ইনায়েতুর রহিমকেও শীঘ্রই আপিল বিভাগে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এটর্নি জেনারেল দফতরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা আমার দেশকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তাঁকে আপিল বিভাগে নিতেও ডিঙ্গাতে হবে ২১ জন সিনিয়রকে। তারিক উল হাকিম এবং ওবায়দুর হাসান শাহিনকে আপিল বিভাগে নিয়োগের পর হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকের তালিকায় ক্রম অনুসারে ২২ নাম্বারে রয়েছেন ইনায়েতুর রহিম। তিনিও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চেয়ারম্যান ছিলেন এবং অনেক রাজনৈতিক নেতাকে ফাঁসির হুকুম দিয়েছেন। আওয়ামী পরিবারের সদস্য ইনায়েতুর রহিম ছাত্রজীবনে জাতীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। তাঁর ছোট ভাই ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসির রায় দেয়ার পুরস্কার হিসাবেই তাঁকে আপিল বিভাগে নেয়ার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। গত বুধবার আপিল বিভাগে নিয়োগ দেয়া তারিক উল হাকিম চলতি মাসেই অবসরে যাবেন। চলতি মাসের ২০ তারিখে তাঁর বয়স ৬৭ পূর্ণ হবে। ফলে ওইদিনই তাঁকে অবসরে যেতে হবে। তারিক উল হাকিম অবসরে যাওয়ার পরই ইনায়েতুর রহিমকে যাতে নিয়োগ দেয়া যায় সে প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।
এর আগে ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে দায়িত্বে ছিলেন নিজামুল হক নাসিম। ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দেয়ার প্রক্রিয়া কিভাবে এগিয়ে নেয়া হচ্ছিল তা উঠে আসে নিজামুল হক নাসিম ও তাঁর বন্ধু আহমদ জিয়াউদ্দিনের ফাঁস হওয়া কথোপকথনের মধ্যে। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ৫ দিন দৈনিক আমার দেশ তাদের কথোপকথনের সিরিজ প্রকাশ করে। এই কথোপকথনে উঠে আসে রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দিয়ে হত্যার সার্বিক পরিকল্পনার প্রসঙ্গটি।
স্কাইপ স্ক্যান্ডাল প্রকাশের পর প্রথম গঠিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করেন। তবে তাঁর রেখে যাওয়া প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম এগিয়ে নেয় ইনায়েতুর রহিম ও ওবায়দুল হাসান শাহিনের নেতৃত্বাধীন দু’টি ট্রাইব্যুনাল। ওবায়দুল হাসান শাহিনের নেতৃত্বাধীন গঠিত ট্রাইব্যুনালে ১১টি মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসির রায় দেয়া হয়।
পদত্যাগের পর নিজামুল হক নাসিমকে পুনরায় হাইকোর্ট বিভাগে ফিরিয়ে নেয়া হয়। কিছুদিন হাইকোর্ট বিভাগে রাখার পর তাঁকে পুরস্কৃত করতে নিয়োগ দেয়া হয় আপিল বিভাগে। যদিও বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে নিজের বন্ধুর সাথে পরামর্শ এবং বন্ধুর নিকট থেকে নানা রায় লিখিয়ে নিয়ে আসার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে আসে স্কাইপ কথোপকথনে। বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে কারো সাথে পরামর্শ করার বিষয়টি বিচারকদের আচরণবিধি চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘনের সামিল। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে শাস্তি যেখানে অনিবার্য। অথচ, শাস্তির জায়গায় তাঁকে পুরস্কৃত করা হয় ২৩ জনকে ডিঙ্গিয়ে আপিল বিভাগে নিয়োগের মাধ্যমে।
রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে হত্যা পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। নিজেদের ভেতর স্বার্থের দ্বন্দ্বে গলাধাক্কা খেয়ে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে বিদায় নিলেও তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল বিভিন্ন পর্যায়ে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তাঁর বিশ্বস্ত হিসাবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে আপিল বিভাগে নেয়া হয় সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে। এছাড়া তখন আপিল বিভাগে তাঁকে নিয়োগ দিতে বিচারকের সংখ্যা ৭ জন থেকে ১১ জনে উন্নীত করা হয়েছিল। এই ১১ জনের মধ্যে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। বলা হয়ে থাকে হাইকোর্ট বিভাগে সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে তাঁকে নিয়োগ দিতেই বিচারকের সংখ্যা আপিল বিভাগে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সুরেন্দ্র কুমারই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আপিল বিভাগে ক্রম অনুসারে ১১তম ছিলেন। এরপর আর এত বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি আপিল বিভাগে। তাঁর ১১তম ক্রমে আর কারো নাম নেই।
উল্লেখ্য, সুরেন্দ্র কুমার সিনহার লেখা আত্মজীবনী ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম’ বইয়ে লিখেছেন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল কিভাবে গঠিত হয়েছিল। তিনি উল্লেখ করেন, তাদের নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসির কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে। নিজেদের ভেতর পরিকল্পনা অনুযায়ী তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যান প্রস্তাব নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে রাজি হননি। আইনমন্ত্রী ফিরে এসে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার জন্য। সে অনুযায়ী সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন এবং কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে সুরেন্দ্র কুমার উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথায়ও রাজি হননি। এক পর্যায়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে সক্ষম হন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়োজনীয়তা। ওবায়দুল হাসানসহ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে বিচারক কে হবেন সেটাও চূড়ান্ত করেছেন বলে নিজের লেখায় দাবী করেন।
সুরেন্দ্র কুমার শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয় তাঁর নিজের লেখার মাধ্যমে। স্বার্থের দ্বন্দ্বে পদচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের বিচারিক পদকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে সকল সহযোগিতাই তিনি করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য, রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দেয়া বিচারকদের পুরস্কৃত করার পাশাপাশি হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত সর্বত্র বিচারকের পোশাকে আওয়ামী রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে সাজানো হচ্ছে।